এই পোস্টে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতা টি দেওয়া আছে। কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন সম্ভবত জেলে বসে। আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ কবিতায় আছে সৃষ্টিশীলতার অমিতাচারী উদ্যাপন। আছে নজরুলের কবি-স্বভাবের পরিচ্ছন্ন বয়ান। এ কবিতার বেগ এবং আবেগ মুক্তি পেয়েছে চার মাত্রার স্বরবৃত্তে। একটি অতিপর্ব, আর অন্যটি হলন্ত ধ্বনির তুর্কি-নাচন। বিদ্রোহী’, ‘আমার কৈফিয়ত’ কিংবা ‘দারিদ্র্য’ কবিতার মতো ‘আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ও নজরুলের অন্যতম প্রধান কাব্য-ইশতেহার। নিচে থেকে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতার ব্যাখ্যা ও মূলভাব সহ কবিতা টি পড়ুন।
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতা
এই কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন। তার অন্যান্য কবিতার মতো এটি একটি জনপ্রিয় কবিতা। এই কবিতাটি নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্য বই থেকে সংগ্রহ করে দেওয়া হয়েছে। পোস্টের নিচের অংশে কবিতা টি পিডিএফ ফাইলে শেয়ার করেছি। যারা যারা কবিতা পড়তে চান নিচে থেকে পড়ে নিবেন।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
– কাজী নজরুল ইসলাম
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে–
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে –
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার – ভাঙা কল্লোলে।
আসল হাসি, আসল কাঁদন
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে।
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে –
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিণাক-পাণির শূল আসে!
ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,
আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগ বালিকার পীতবাসে;
আজ রঙ্গন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ কপট কোপের তূণ ধরি,
ঐ আসল যত সুন্দরী,
কারুর পায়ে বুক ডলা খুন, কেউ বা আগুন,
কেউ মানিনী চোখের জলে বুক ভাসে!
তাদের প্রাণের ‘বুক-ফাটে-তাও-মুখ-ফোটে-না’ বাণীর বীণা মোর পাশে
ঐ তাদের কথা শোনাই তাদের
আমার চোখে জল আসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে!
আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল সুদূর
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে!
ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসল শিশির দুবঘাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ জাগল সাগর, হাসল মরু
কাঁপল ভূধর, কানন তরু
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে।
মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে!!
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতার মূলভাব
কাজী নজরুল ইসলাম ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সালে(২৫শে মে ১৮৯৯)ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।ছেলেবেলায় তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন।পরে বর্ধমানে ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন।১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান।সেখানেই তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনা ঘটে।তাঁর লেখায় তিনি সামাজিক অবিচার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।
এজন্য তাঁকে‘বিদ্রোহী কবি’বলা হয়।বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে।কবিতা,উপন্যাস,নাটক,ছোটগল্প,প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।তিনি গজল,খেয়াল ও রাগপ্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন।আরবি-ফরাসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে।মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কবি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবংপরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়।তাঁর অসাধারণ সাহিত্য কৃতীর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি প্রদান করে।
তাঁর রচিত কাব্যগুলোর মধ্যে অগ্নিবীণা,বিষের বাঁশি,ছায়ানট,প্রলয়শিখা,চক্রবাক,সিন্ধুহিন্দোল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।ব্যথার দান,রিক্তের বেদন,শিউলিমালা,মৃতুক্ষুধা,কুহেলিকা ইত্যাদি তাঁর রচিত গল্প ও উপন্যাস।যুগবাণী,দুর্দিনের যাত্রী ও রাজবন্দীর জবানবন্দী তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ।২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে কবি ঢাকার পি.জি. হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদসংলগ্ন প্রাঙ্গণে তাঁকে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতার পাঠ পরিচিতি
কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কয়েকটি কবিতার অন্যতম একটি হলো‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’।কবিতাটি তাঁর-কাব্যগ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত আকারে চয়ন করা হয়েছে। এই কবিতায় কবির সৃষ্টি-সুখের আনন্দ অসাধারণ আবেগ ও উচ্ছ্বাসের মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে।কবির ভাবনায়, বিশ্বাসে ও জাগতিক নিয়মে এতদিন যেটি ছিল রুদ্ধ তা যেন আজ শত ধারায় উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। সর্বত্রই এখন তিনি অনুভব করেন সৃষ্টির কোলাহল, গতির উন্মাদনা, প্রাণের উচ্ছ্বাস আর মুক্তির আনন্দ। এই অফুরন্ত ভাবাবেগ ব্যক্ত করতে গিয়ে কবি যে কাব্যভাষা প্রয়োগ করেছেন বাংলা কবিতার ইতিহাসে তা একান্তই নতুন ও প্রথাবিরোধী। এই কবিতার মধ্যে নজরুলের কাব্য প্রতিভার সকল মাত্রার আনন্দিত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতার শব্দার্থ
- উল্লাস- পরম(বা চূড়ান্ত)আনন্দ,হৃষ্টতা;
- সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে- পরম আনন্দ সৃষ্টি করতে পারার পরম আনন্দ;
- পল্বল- বিল, ক্ষুদ্র জলাশয়;
- রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে- প্রাণে বন্ধ জলাশয়ে বা প্রাণ রূপ জলাশয়ে;
- কল্লোল– জলস্রোতের কলকল শব্দ,মহা তরঙ্গ বা ঢেউ;
- রুদ্ধ প্রাণের…কল্লোলে- প্রাণ রূপ জলাশয়ে দুয়ার ভাঙা ঢেউ বা তরঙ্গ জোয়ার এনেছে;
- হুতাশ- অগ্নি, হুতাসন;
- শ্বসল- নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করা;
- শ্বসল হুতাশ- অগ্নি নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করল-অর্থাৎ আগুন অতি তেজের সঙ্গে জ্বলে উঠল;
- চক্র- চাকা।এখানে হিন্দু পুরাণমতে দেবতা বিষ্ণুর হাতে অন্যায় ধ্বংসকারী চাকাকে বোঝানো হয়েছে;
- পিনাক- হিন্দু পুরাণমতে দেবতা শিবের ধনু;
- পিনাকপাণি- পিনাক পাণিতে(হাতে)যার,
- শিব শূল- এখানে হিন্দু পুরাণমতে দেবতা শিবের হাতের ত্রিশূলকে বোঝানো হয়েছে। ধারালো অগ্রভাগবিশিষ্ট কাঠ বা লোহার ডান্ডা বা লাঠি;
- ফাগুন- ফাগুন বা বসন্তকাল;
- মদন- হিন্দু পুরাণমতে প্রেমের দেবতা;
- মদন মারে খুন মাখা তূণ- প্রেমের দেবতা মানুষের হৃদয়ে তীর বিদ্ধ করেন বলে তা হৃদয়ের রক্ত মাখা বলে মনে করা হচ্ছে;
- ঘায়েল- আহত,আঘাতপ্রাপ্ত।এখানে বসন্তকালের রঙে রঞ্জিত বোঝানো হয়েছে;
- ফাগ- আবীর,নানা রঙের গুঁড়ো;
- দিক-বাসে- দিগন্তরেখা রূপ বস্ত্রে;
- পীত- হলুদ রং,হলদে;
- দিগবালিকার পীতবাসে- দিগন্ত রূপ বালিকার হলুদ রঙের বস্ত্রে বা বসনে;
- গাজন- (পুরাণমতে)চৈত্র মাসের শেষে(অর্থাৎ বসন্তকালে)দেবতা শিবকে নিয়ে গান;
- আশিন- আশ্বিন মাস;
- দুব্- দূর্বা,এক রকমের ঘাস;
- উছলে- উচ্ছলিত;
- উজান- স্রোতের বিপরীত দিক;
- ভৈরবী- শিব অনুসারী সন্ন্যাসিনী,ভয়ংকরী;
- বিশ্বডুবাল….গান ভাসে- স্রোতের বিপরীত দিক থেকে ঠেলে বিশ্ব ডোবানো ঝড় এসেছে,তার সঙ্গে তান্ডব নৃত্যকারী শিবের অনুসারী সন্ন্যাসিনীদের গান মিশেছে।
শেষ কথা
আমাদের সাথে শেষ পর্যন্ত থাকার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আশা করছি এই পোস্ট টি আপনাদের অনেক ভালো লেগেছে । আশা করছি এই পোস্ট থেকে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতা ও কবিতার ব্যাখ্যা, মূলভাব সংগ্রহ করতে পেরেছেন। এই রকম আরও ভালো ভালো পোস্ট পেতে আমাদের সাথেই থাকবেন। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সকল শ্রেণির শিক্ষাসংক্রান্ত তথ্য শেয়ার করা হয়। ভালোথাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
আরও দেখুনঃ
জীবন বিনিময় কবিতা- গোলাম মোস্তফা। বাংলা ১ম পত্র
ছায়াবাজি কবিতা- সুকুমার রায়। বাংলা ১ম পত্র এস এস সি
ঝর্ণার গান কবিতার MCQ ও বহুনির্বাচনি প্রশ্নের উত্তর PDF
PDF ঝর্ণার গান কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন ও উত্তর এস এস সি
ঝর্ণার গান কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন উত্তর-PDF
ঝর্নার গান কবিতা – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। এস এস সি বাংলা ১ম পত্র
জুতা আবিষ্কার কবিতার mcq প্রশ্নের উত্তর পিডিএফ
জুতা আবিষ্কার কবিতার সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর