পৃথিবী ও মহাকর্ষ ৮ম শ্রেণি

পৃথিবী ও মহাকর্ষ ৮ম শ্রেণি

পৃথিবী ও মহাকর্ষের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে যা মহত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী। মহাকর্ষ পৃথিবীর গতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং পৃথিবীকে তার পথে ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এটি আকার গ্রহবিদ্যার নীতির জন্য দায়িত্বশীল।মহাকর্ষের কারণে, পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলি আকার ধারণ করে এবং তাদের পথ অনুসরণ করে নিয়মিত গতিতে ঘোরায়। এটি ছাড়াও, মহাকর্ষের প্রভাবে গ্রহের আবদ্ধতা, আবদ্ধতা এবং তাদের গতি নিয়ে গবেষণা করা হয়। নিচে পৃথিবী ও মহাকর্ষ ৮ম শ্রেণি বইয়ের ব্যাখ্যা গুলো বিস্তারিত দেওয়া আছে।

পৃথিবী ও মহাকর্ষ ৮ম শ্রেণি

এ মহাবিশ্বের প্রতিটি কন্তু একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ বল কি সকল ক্ষেত্রে সমান? কিসের উপর এই বলের মান নির্ভর করে। পৃথিবীর আকর্ষণের ফলে পড়ন্ত বস্তুর যে ত্বরণ হয় তার মান কত, এই মান কেন পরিবর্তিত হয়। এই অধ্যায়ে আমরা মহাকর্ষ, অভিকর্ষ, অভিকর্ষজ ত্বরণ, ভর ও ওজন নিয়ে আলোচনা করব।

মহাকর্ষ

আমরা লাফ দিয়ে উপরের দিকে উঠতে চাইলে বেশি দূর উঠতে পারি না। আবার ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসি । গাছের ফল মাটিতে পড়ে। ক্রিকেট বলকে উপরের দিকে ছুড়ে দিলে মাটিতে পড়ে। এর কারণ কী? কারণ পৃথিবী আমাদেরকে তার নিজের দিকে টানে বা আকর্ষণ করে। শুধু পৃথিবী কেন, সবকিছুই আমাদের আকর্ষণ করে। আসলে এ মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি বস্তুকণা একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ বলকে মহাকর্ষ বলে।

তোমরা নিশ্চয়ই নিউটন ও আপেল মাটিতে পড়ার কাহিনী শুনে থাকবে। কথিত আছে, নিউটন একদিন বাগানে বসে চিন্তা করছিলেন। এমন সময় তিনি গাছ থেকে একটি আপেল মাটিতে পড়তে দেখেন। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, আপেলটি মাটিতে পড়ল কেন? নিশ্চয়ই কেউ একে মাটির দিকে টানছে। চিন্তা-ভাবনা শেষে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পৃথিবী সকল বস্তুকে তার নিজের দিকে টানে। পরে তিনি আরও সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, শুধু পৃথিবী নয়, এ মহাবিশ্বের সকল বস্তুকণাই একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এ বিশ্বের যেকোনো দুটি বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ তাকে মহাকর্ষ বলে।

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র ও মহাকর্ষ বল
দুটি বস্তুকণার মধ্যকার এ আকর্ষণ বলের মান শুধু বস্তুদ্বয়ের ভর এবং এদের মধ্যকার দূরত্বের উপর নির্ভর করে। এদের আকৃতি, প্রকৃতি কিংবা মাধ্যমের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে না। বস্তুদ্বয়ের ভর বেশি হলে, আকর্ষণ বলও বেশি হয় আর তাদের মধ্যে দূরত্ব বেশি হলে বল কম হয়। এ আকর্ষণ সম্পর্কে নিউটনের একটি সূত্র আছে যা নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র নামে পরিচিত।

সূত্র : মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে এবং এ আকর্ষণ বলের মান বস্তুকণাদ্বয়ের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং এদের দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক এবং এ বল বস্তুকণাদ্বয়ের সংযোজক সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে।

ধরা যাক, m এবং mg ভরের দুটি বস্তু পরস্পর থেকে d দূরত্বে অবস্থিত (চিত্র ৭.১)। এদের মধ্যকার আকর্ষণ বল F হলে, মহাকর্ষ সূত্রানুসারে,

এখানে G একটি সমানুপাতিক ধ্রুবক। একে বিশ্বজনীন মহাকর্ষীয় ধ্রুবক বলে। এর অর্থ হচ্ছে এক কিলোগ্রাম ভরের দুটি বস্তু এক মিটার দূরত্বে স্থাপন করলে এরা পরস্পরকে যে বলে আকর্ষণ করে তা G এর সমান।

মহাকর্ষ সূত্রানুসারে আমরা দেখতে পাই, নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত দুটি বস্তুর ভরের গুণফল দ্বিগুণ হলে বল দ্বিগুণ হবে, ভরের গুণফল তিনগুণ হলে বল তিনগুণ হবে। আর নির্দিষ্ট ভরের দুটি বস্তুর দূরত্ব দ্বিগুণ করলে বল এক-চতুর্থাংশ হবে, দূরত্ব তিনগুণ করলে বল নয় ভাগের এক ভাগ হবে। মহাকর্ষ বলের প্রভাবে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। এবার বলো, অন্য সকল গ্রহ সূর্যের চারদিকে ঘুরে কেন?

অভিকর্ষ ও অভিকর্ষজ ত্বরণ

অভিকর্ষ :

আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে, এ মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি বস্তুকণাই একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এ মহাবিশ্বের যেকোনো দুটি বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ তাই মহাকর্ষ। দুটি বস্তুর একটি যদি পৃথিবী হয় এবং পৃথিবী যদি বস্তুটিকে আকর্ষণ করে তবে তাকে মাধ্যাকর্ষণ বা অভিকর্ষ বলে। অর্থাৎ কোনো বস্তুর উপর পৃথিবীর আকর্ষণই অভিকর্ষ। গাছের ফল মাটিতে পড়ে। ক্রিকেট বলকে উপরের দিকে ছুড়ে দিলেও বলটি মাটিতে এসে পড়ে। এখানে পৃথিবী যেমন ফল বা ক্রিকেট বলকে আকর্ষণ করে তেমনি এরাও পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। পৃথিবী অনেক বড় এবং এর আকর্ষণ বল অনেক বেশি হওয়ায় ফল ও ক্রিকেট বল মাটিতে পড়ে। পৃথিবী এবং অন্য যেকোনো বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ তাকে অভিকর্ষ বলে। সূর্য ও চন্দ্রের মধ্যে যে আকর্ষণ তা মহাকর্ষ, কিন্তু পৃথিবী এবং তোমার বিজ্ঞান বই–এর মধ্যে যে আকর্ষণ তা অভিকর্ষ।

অভিকর্ষজ ত্বরণ :

আমরা জানি বল প্রয়োগ করলে কোনো বস্তুর বেগের পরিবর্তন হয়। প্রতি সেকেন্ডে যে বেগ বৃদ্ধি পায় তাকে ত্বরণ বলে। অভিকর্ষ বলের প্রভাবেও বস্তুর ত্বরণ হয়। এ ত্বরণকে অভিকর্ষজ ত্বরণ বা মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ বলা হয়। যেহেতু বেগ বৃদ্ধির হারকে ত্বরণ বলে, সুতরাং অভিকর্ষ বলের প্রভাবে ভূপৃষ্ঠে মুক্তভাবে পড়ন্ত কোনো বস্তুর বেগ বৃদ্ধির হারকে অভিকর্ষজ ত্বরণ বলে।

অভিকর্ষজ ত্বরণকে g দ্বারা প্রকাশ করা হয়। যেহেতু অভিকর্ষজ ত্বরণ এক প্রকার ত্বরণ, সুতরাং এর একক হবে ত্বরণের একক অর্থাৎ মিটার/
সেকেন্ড

ধরা যাক, M = পৃথিবীর ভর, m = ভূপৃষ্ঠে বা এর নিকটে অবস্থিত কোনো বস্তুর ভর, d = বস্তু ও পৃথিবীর কেন্দ্রের মধ্যবর্তী দূরত্ব। তাহলে মহাকর্ষ সূত্রানুসারে অভিকর্ষ বল,
F=GMnd2
আবার বলের পরিমাপ থেকে আমরা পাই, অভিকর্ষ বল = ভর x অভিকর্ষজ ত্বরণ

অর্থাৎ F = mg

উপরিউক্ত দুই সমীকরণ থেকে পাওয়া যায়,

এ সমীকরণের ডান পাশে বস্তুর ভর m অনুপস্থিত। সুতরাং অভিকর্ষজ ত্বরণ বস্তুর ভরের উপর নির্ভর করে না। যেহেতু G এবং পৃথিবীর ভর M ধ্রুবক, তাই g-এর মান পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে বস্তুর দূরত্ব d-এর উপর নির্ভর করে। সুতরাং g-এর মান বস্তু নিরপেক্ষ হলেও স্থান নিরপেক্ষ নয়। এর অর্থ হলো g-এর মান বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম হয়।

অভিকর্ষজ ত্বরণের পরিবর্তন :

পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠের দূরত্ব অর্থাৎ পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R হলে ভ্রূপৃষ্ঠে �=���2

যেহেতু পৃথিবী সম্পূর্ণ গোলাকার নয়, মেরু অঞ্চলে একটুখানি চাপা, তাই পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R ধ্রুবক নয়। সুতরাং ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র g-এর মান সমান নয়। মেরু অঞ্চলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ R সবচেয়ে কম বলে সেখানে g-এর মান সবচেয়ে বেশি। মেরু অঞ্চলে g-এর মান ৯.৮৩ মিটার/সেকেন্ড২। মেরু থেকে বিষুব অঞ্চলের দিকে R এর মান বাড়তে থাকায় g-এর মান কমতে থাকে। বিষুব অঞ্চলে R এর মান সবচেয়ে বেশি বলে g-এর মান সবচেয়ে কম। ৯.৭৮ মিটার/সেকেন্ড২। হিসাবের সুবিধার জন্য ভূপৃষ্ঠে g-এর আদর্শ মান ধরা হয় ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড২। এর অর্থ হচ্ছে ভূপৃষ্ঠে মুক্তভাবে পড়ন্ত কোনো বস্তুর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৯.৮ মিটার/সেকেন্ড বৃদ্ধি পায়।

কোনো বস্তুকে উপর থেকে ছেড়ে দিলে অভিকর্ষ বলের প্রভাবে ভূমিতে পৌঁছায়। একই উচ্চতা থেকে একই সময় এক টুকরা পাথর ও এক টুকরা কাগজ ছেড়ে দিলে এগুলো একই সময়ে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছাবে কি? যেহেতু বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল অভিকর্ষজ ত্বরণ বস্তুর ভরের উপর নির্ভর করে না, তাই পাথর ও কাগজের উপর ক্রিয়াশীল অভিকর্ষজ ত্বরণ একই। সুতরাং তাদের একই সময়ে মাটিতে পৌঁছানো উচিত। কিন্তু বাস্তবে পাথরটি কাগজের আগেই মাটিতে পৌঁছায়। বাতাসের বাধার বিভিন্নতার কারণে এরূপ হয়। বাতাসের বাধা না থাকলে এগুলো অবশ্যই একই সময়ে মাটিতে পৌঁছাত।

ভর ও ওজন

যখন আমরা বলি কবিরের ওজন ৯০ কিলোগ্রাম (কেজি) তখন আমরা আসলে বুঝাই যে, কবিরের দেহের ভর ৯০ কিলোগ্রাম (কেজি)। আমরা যখন ৫০ কেজি চাউলের বস্তা কিনি তখন আমরা আসলে ঐ বস্তার চাউলের ভর ৫০ কেজি বুঝি, কিন্তু বস্তার চাউলের ওজন বুঝাই না।

পদার্থবিজ্ঞানে ভর ও ওজন সম্পূর্ণ পৃথক দুটি রাশি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা ওজন কথাটাকে অপব্যবহার করি যা একে ভুল অর্থে বোঝায়। আসলে আমরা কোনো বস্তুর ভরকে ঐ বস্তুর ওজন বলে থাকি। তবে ভর ও ওজনের পার্থক্য কী?

ভর : 

প্রত্যেক বস্তু পদার্থ দ্বারা গঠিত। ভর হলো কোনো বস্তুতে পদার্থের পরিমাণ। বস্তুর ধর্ম এর অবস্থান, আকৃতি ও গতি পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তিত হয় না। যে পরমাণু ও অণু দিয়ে বস্তুটি গঠিত তার সংখ্যা ও সংযুক্তির উপর বস্তুটির ভর নির্ভর করে। ভরের আন্তর্জাতিক একক হলো কিলোগ্রাম বা কেজি (kg)। বেশি ভরকে (যেমন এক ট্রাক চাউল) মেট্রিক টনে মাপা হয়। এক টন ১০০০ কিলোগ্রামের সমান। অল্প ভরকে মাপা হয় গ্রামে। যেমন কোনো পেনসিলের ভর ৫ গ্রাম (g)। ১ কেজি সমান ১০০০ গ্রাম৷

ওজন : 

আমরা জানি যে, কোনো বস্তুকে উপরের দিকে ছুড়ে দিলে ভূমিতে ফিরে আসে। এটা ঘটে বস্তুর ওজনের জন্য যা একে পৃথিবীর দিকে টানে। পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের কারণে এটা ফিরে আসে।

কোনো বস্তুকে পৃথিবী যে বল দ্বারা তার কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে তাকে বস্তুর ওজন বলে। কোনো বস্তুর ভর m এবং পৃথিবীর কোনো স্থানে অভিকর্ষজ ত্বরণ g হলে ঐ স্থানে বস্তুর ওজন W হবে, W = mg

ওজনের একক হলো বলের একক অর্থাৎ নিউটন। পৃথিবী পৃষ্ঠে ১০ কেজি ভরের বস্তুর ওজন হবে W = 10 x ৯.৮ নিউটন

সাধারণত স্প্রিং নিক্তির সাহায্যে কোনো বস্তুর ওজন পরিমাপ করা হয়।

ভর ও ওজনের সম্পর্ক

আমরা জানি বস্তুর মধ্যে পদার্থের পরিমাণই হচ্ছে এর ভর। ভর হচ্ছে একটি ধ্রুব রাশি যা ভূপৃষ্ঠে বা ভূপৃষ্ঠের উপরে বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয় না। ৭৫ কেজি ভরের একজন মহাশূন্যচারীর ভর চাঁদে কিংবা পৃথিবীর বা চাঁদের কক্ষপথেও ৭৫ কেজিই থাকবে। মহাশূন্যচারী যতটুকু পদার্থ দিয়ে তৈরি, তা তার স্থান পরিবর্তনের ফলেও কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না বলে তার ভর সর্বত্র অপরিবর্তিত থাকে।

যেহেতু বস্তুর ভর একটি ধ্রুব রাশি, সুতরাং বস্তুর ওজন অভিকর্ষজ ত্বরণ g এর উপর নির্ভর করে। যেসব কারণে অভিকর্ষজ ত্বরণের পরিবর্তন ঘটে সেসব কারণে বস্তুর ওজনও পরিবর্তিত হয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে উঠা যায় বস্তুর ওজন তত কমতে থাকে। বস্তুর ওজন বস্তুর মৌলিক ধর্ম নয়। কোনো কতুর ওজন থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষজ ত্বরণ শূন্য, তাই সেখানে বস্তুর ওজনও শূন্য। মহাশূন্যে কোনো বস্তুর ওজন শূন্য হলে তখন বস্তুর উপর কোনো মহাকর্ষ বল কাজ করে না। চাদের অভিকর্ষজনিত ত্বরণের মান প্রায় পৃথিবীর উ ভাগ। সুতরাং চাঁদে ১ কেজি ভরের বস্তুর ওজন হবে প্রায় ১.৬৩ নিউটন (N)।

কোনো বস্তুর ওজন পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে তার দূরত্বের উপর নির্ভর করে। যদি দূরত্ব বাড়ানো হয় তাহলে তার উপর পৃথিবীর আকর্ষণ কমে যায়, ফলে বস্তুর ওজন হ্রাস পায়। ভূপৃষ্ঠে ১ কেজি ভরের কোনো বস্তুর ওজন ৯.৮ নিউটন হলেও পৃথিবী থেকে দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে বস্তুর ওজন কমতে থাকে।

পৃথিবীর পৃষ্ঠেও কোনো বস্তুর ওজনের অতি সামান্য তারতম্য ঘটে। এর একটি কারণ হচ্ছে পৃথিবী সুষম গোলক নয় এবং ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র অভিকর্ষজ ত্বরণের মানও এক নয়। অবশ্য এ পার্থক্য এত ক্ষুদ্র যে কেবল সুবেদী ওজন মাপক যন্ত্রের সাহায্যেই তা পরিমাপ করা যাবে। অধিকাংশ হিসাব নিকাশের সময় আমরা এ পার্থক্য উপেক্ষা করি। ১ কেজি ভরের কোনো বস্তুর ওজন সবচেয়ে বেশি হবে পৃথিবীর দুই মেরুতে অর্থাৎ উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে। যেখানে এর ওজন হবে ৯.৮৩ নিউটন। বিষুবীয় অঞ্চলে এর ওজন সবচেয়ে কম হবে ৯.৭৮ নিউটন। ক্রান্তীয় অঞ্চলের ওজন হবে ৯.৭৯ নিউটন।যেহেতু বস্তুর ভর বেশি হলে তার ওজনও বেশি হয়, ওজন ভরের সমানুপাতিক। সুতরাং যে সকল যন্ত্র দিয়ে ওজন মাপা যায় সেগুলো দিয়ে ভরও মাপা যায়। স্প্রিং নিক্তি অনেক সময় কিলোগ্রাম এককে দাগাঙ্কিত থাকে। যেহেতু নিক্তি এবং ওজন মাপক যন্ত্রগুলো এমনভাবে দাগাঙ্কিত থাকে যে, অনেক সময় আমরা ভর ও ওজন উভয়ের জন্যই কিলোগ্রাম একক ব্যবহার করে থাকি। এটি অবশ্যই ভুল। ওজন এক প্রকার বল এবং বৈজ্ঞানিক হিসাব-নিকাশের সময় তা অবশ্যই নিউটন এককে পরিমাপ করতে হবে। যখন আমরা ১কেজি লিখিত একটি চাউলের প্যাকেট বা একটি দুধের টিন কিনি—তখন বুঝি ঐ প্যাকেটের চাউলের বা টিনের দুধের ভর ১ কেজি কিন্তু ওজন ১ কেজি নয়, পৃথিবীতে এগুলোর ওজন হবে ৯.৮ নিউটন। চাউলের প্যাকেটের ওজন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে বা চাঁদে ভিন্ন হবে যদিও ভরের কোনো পরিবর্তন হবে না।

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অভিকর্ষজ ত্বরণ ও বস্তুর ওজন

বস্তুর ওজন অভিকর্ষজ ত্বরণ g এর উপর নির্ভরশীল। সুতরাং যে সকল কারণে অভিকর্ষজ ত্বরণের পরিবর্তন ঘটে সে সকল কারণে বস্তুর ওজনও পরিবর্তিত হয়। বস্তুর ওজন বস্তুর মৌলিক ধর্ম নয়। স্থানভেদে বস্তুর ওজনের পরিবর্তন হয়। যে সকল কারণে ওজনের পরিবর্তন হয় নিচে তা বর্ণনা করা হলো।

(ক) ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে : পৃথিবীর আকৃতি ও আহ্নিক গতির জন্য বিভিন্ন স্থানে বস্তুর ওজন বিভিন্ন হয়।

(১) পৃথিবীর আকৃতির জন্য : পৃথিবী সুষম গোলক না হওয়ায় পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠের সকল স্থান সমদূরে নয়। যেহেতু g এর মান পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে দূরত্বের উপর নির্ভর করে, তাই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে g এর মানের পরিবর্তন হয়। বিষুবীয় অঞ্চলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ সবচেয়ে বেশি হওয়ায় g এর মান সবচেয়ে কম (৯.৭৮ মিটার/সেকেন্ড২)। সুতরাং বিষুবীয় অঞ্চলে কোনো বস্তুর ওজন সবচেয়ে কম হয়। বিষুবীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে যত যাওয়া যায়, ব্যাসার্ধ তত কমতে থাকে এবং g এর মান বাড়তে থাকে (৯.৮৩ মিটার/সেকেন্ড২) । এর ফলে বস্তুর ওজনও বাড়তে থাকে। মেরু অঞ্চলে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ সবচেয়ে কম হওয়ায় g এর মান মেরু অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি। ফলে ওজনও সবচেয়ে বেশি হয়।

(২) পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য : পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্য অভিকর্ষজ ত্বরণ বিষুবীয় অঞ্চল থেকে মে অঞ্চলের দিকে ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে বস্তুর ওজনও বৃদ্ধি পায়।

(খ) ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতর কোনো স্থানে : ভূপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে উঠা যায় অভিকর্ষজ ত্বরণের মানও তত কমতে থাকে। এর ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে উঠা যায় বস্তুর ওজনও তত কমতে থাকে। এই কারণে পাহাড় বা পর্বতশীর্ষে বস্তুর ওজন কম হয়।

(গ) পৃথিবীর অভ্যন্তরে কোনো স্থানে : ভূপৃষ্ঠ থেকে যত নিচে যাওয়া যায় অভিকর্ষজ ত্বরণের মান ততই কমতে থাকে। এর ফলে পৃথিবীর যত অভ্যন্তরে যাওয়া যায় বস্তুর ওজন তত কমতে থাকে। এ কারণে খনিতে কোনো বস্তুর ওজন কম হয়। পৃথিবীর কেন্দ্রে অভিকর্ষজ ত্বরণের মান শূন্য। সুতরাং পৃথিবীর কেন্দ্রে যদি কোনো বস্তুকে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে বস্তুর উপর পৃথিবীর কোনো আকর্ষণ থাকবে না, অর্থাৎ বস্তুর ওজন শূন্য হবে।

লিফটে ও মহাশূন্যে ওজনের তারতম্য : ওজনহীনতা

ভূপৃষ্ঠের কোনো একটি স্থানে g এর মান নির্দিষ্ট, ফলে সেখানে কোনো ব্যক্তির ওজনও নির্দিষ্ট। তা সত্ত্বেও সেখানে কোনো ব্যক্তির ওজনের ভিন্নতা অনুভব করতে পারেন এবং নিজেকে ওজনহীনও মনে করতে পারেন। আসলে ওজন আর ওজন অনুভব করা এক কথা নয়। পৃথিবীতে কোনো ব্যক্তির উপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল থাকবেই। ফলে তার ওজন থাকবেই কিন্তু তিনি সেই ওজন অনুভব করবেন কেবলমাত্র তখনই যখন তার ওজনের সমান ও বিপরীতমুখী কোনো প্রতিক্রিয়া বল তার উপর প্রযুক্ত হবে।

আমরা যখন লিফটে চড়ে উঁচু দালানে উঠানামা করি তখন আমরা ওজনের তারতম্য অনুভব করি। আমরা যখন কোনো স্থির লিফটে দাঁড়াই তখন আমরা লিফটের মেঝের উপর আমাদের ওজনের সমান বল প্রয়োগ করি, লিফটও আমাদের উপর ওজনের সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে— আমরা আমাদের ওজনের অস্তিত্ব টের পাই। কিন্তু লিফট যদি উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন স্থির অবস্থান থেকে উপরের দিকে যাত্রা করায় লিফটটির উপরের দিকে একটি ত্বরণ সৃষ্টি হয় ফলে লিফটের সাপেক্ষে আমাদের ত্বরণ হয় g এর চেয়ে বেশি। এ বর্ধিত ত্বরণের জন্য আমরা লিফটের উপর আমাদের ওজনের চেয়ে বেশি বল প্রয়োগ করি। তখন লিফটও আমাদের উপর বিপরীতমুখী যে প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে তা আমাদের ওজনের চেয়ে বেশি হয় এবং নিজেদেরকে ভারী অনুভব করি। কিন্তু এরপর লিফট যখন সমবেগে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন তার কোনো ত্বরণ থাকে না, ফলে আমরা আর ওজনের চেয়ে অতিরিক্ত বল অনুভব করি না, কেবল ওজনই অনুভব করি। অপরপক্ষে লিফট যখন নিচে নামতে শুরু করে তখন স্থির অবস্থান থেকে একটি ত্বরণ সৃষ্টি হয় এবং লিফটের সাপেক্ষে আমাদের ত্বরণ g এর চেয়ে কম হয়। এ কম ত্বরণ নিয়ে আমরা লিফটের উপর আমাদের ওজনের চেয়ে কম বল প্রয়োগ করি। ফলে, আমরা হালকা বোধ করি অর্থাৎ আমাদের ওজন কম মনে হয়। লিফট যদি মুক্তভাবে নিচে পড়ে অর্থাৎ, লিফটেরও যদি ত্বরণ হয়, তবে লিফটের g সাপেক্ষে আমাদের ত্বরণ হবে (g – g) অর্থাৎ শূন্য। ফলে আমরা লিফটের উপর কোনো বল প্রয়োগ – করব না। তখন লিফটও আমাদের ওজনের বিপরীতে আমাদের উপর কোনো প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করবে না এবং আমরা নিজেদেরকে ওজনহীন মনে করব। কোনো লিফটের কেবল বা দড়ি ছিঁড়ে গিয়ে লিফটটি যদি অভিকর্ষের প্রভাবে নিচে পড়ে তখন এ অবস্থার উদ্ভব হবে। এ অবস্থায় যদি লিফটের ছাদ থেকে ঝুলন্ত বা লিফটে দাঁড়ানো কোনো ব্যক্তির হাতে ধরা স্প্রিং নিক্তি থেকে একটি বস্তু ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে স্প্রিং নিক্তির কাঁটা শূন্য দাগে অবস্থান করছে। অর্থাৎ, বস্তুটির ওজন শূন্য।

মহাশূন্যযানের পৃথিবী বা চাঁদকে প্রদক্ষিণ করার ও নিকটের মুক্তভাবে নিচে পড়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মহাশূনচারীরা মহাশূন্যযানে করে পৃথিবীকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার বৃত্তাকার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে থাকেন। এ বৃত্তাকার গতির জন্য মহাশূন্যযানের দেয়ালের সাপেক্ষে মহাশূন্যচারীর ত্বরণ শূন্য হয় এবং মহাশূন্যচারী মহাশূন্যবাদের দেয়াল বা মেঝেতে কোনো বল প্রয়োগ করেন না। ফলে তিনি তার ওজনের বিপরীত কোনো প্রতিক্রিয়া কাণ্ড অনুভব করেন না। তাই তিনি ওজনহীনতা অনুভব করেন। এ অবস্থায় মহাশূন্যযান থেকে কোনো বস্তুকে ছেড়ে দিলে পড়ে না, গ্রাসের পানি উপুড় করলেও পড়বে না অর্থাৎ সবকিছুই ওজনহীন মনে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো কিছুই এজনহীন হয় না, কেননা ঐ অবস্থানে মহাশূন্যচারীর ভর আছে, ঐ স্থানে অভিকর্ষজ ত্বরণ ৪ লাহে, ফলে পৃথিবীর আকর্ষণ তথা ওজন আছে। কেবল মহাশূন্যযান ৪ স্বরণে গতিশীল হওয়ার কারণে এ আপাতত ওজনহীনতার উদ্ভব হচ্ছে। যদি ঐ স্থানে মহাশূন্যযান বৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ না করে, বিদ্যা পৃথিবীর দিকে মুক্তভাবে না পড়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু মহাশূন্যচারী অবশ্যই তাঁর ওজন টের পাবেন।

শেষ কথা

মহাকর্ষের প্রভাবে, পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ঘটনাগুলি ঘটে, যেমন মহাসমুদ্রের উচ্চতা, ভূমির চলন্ত প্লেটফর্ম, বৃষ্টির পরিমাণ ইত্যাদি। এই সম্পর্কে আরও অনেক অধ্যায় আছে, যা আমাদের মহাবিশ্ব ও বিজ্ঞানের উপর আরও অনুসন্ধান করতে উৎসাহিত করে। এটি পৃথিবীকে সূর্য ও অন্যান্য গ্রহগুলির পথ নিয়ন্ত্রণ করে এবং বৃহত্তর বৈশিষ্ট্যগুলির প্রতি প্রভাব ফেলে। এটি আমাদের মহাবিশ্বের অগ্রগতির দিকে একটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আশা করছি পৃথিবী ও মহাকর্ষ ৮ম শ্রেণি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।

আরও দেখুনঃ

পরমাণুর গঠন অষ্টম শ্রেণী

পরমাণুর গঠন অষ্টম শ্রেণী mcq প্রশ্ন উত্তর

3 Comments on “পৃথিবী ও মহাকর্ষ ৮ম শ্রেণি”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *