বাংলাদেশ একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। এখানে দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। তাই বস বাসের জন্য অনেক সমস্যা হয়। এছাড়া বাংলাদেশে রয়েছে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যা। প্রতি ঘরেই এই ধরনের সমস্যা দেখা যায়। বাংলাদেশে উন্নতমানের সমাজ ব্যবস্থা নেই। রয়েছে নানা ধরনের প্রতিকূলতা। বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রধান কারণ হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। এছাড়া আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। যা বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও উন্নয়ন এই অধ্যায় থেকে জানতে পারবেন।
বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা
সমাজ ও সামাজিক সমস্যা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সমাজ সৃষ্টির লগ্ন থেকেই সামাজিক সমস্যা ছিল, এখনও রয়েছে। শুধু সমস্যার প্রকৃতি ও ধরনের পার্থক্য ঘটেছে। সামাজিক সমস্যা হলো সমাজের এমন একটা অস্বাভাবিক অবস্থা যা অধিকাংশ লোককে প্রভাবিত করে এবং এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সকলকে একযোগে কাজ করতে হয়। আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে জেনেছি। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অপরিকল্পিত সামাজিক পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা কিংবা ভূমিকা পালনের ব্যর্থতাই সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে। সমাজভেদে সামাজিক সমস্যার রুপ পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশে বহু সামাজিক সমস্যা রয়েছে। এ অধ্যায়ে আমরা সামাজিক নৈরাজ্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নারীর প্রতি সহিংসতা, এইচআইভি এইডস, সড়ক দুর্ঘটনা, জঙ্গিবাদ এবং দুর্নীতি সম্পর্কে অবহিত হব।
সামাজিক নৈরাজ্য ও মূল্যবোধের অবক্ষয়
সাধারণভাবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর ও অসুবিধাজনক অবস্থা বা পরিস্থিতিকেই সামাজিক সমস্যা বলে। সামাজিক সমস্যা সাময়িক সময়ের জন্য সৃষ্টি হয় না। এটি কমবেশি স্থায়ী হয় এবং এর সমাধানের লক্ষ্যে যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজন অনুভূত হয়। সুতরাং সামাজিক সমস্যা হলো সমাজ জীবনের এমন এক অবস্থা, যা সমাজবাসীর বৃহৎ অংশকে প্রভাবিত করে, যা অবাঞ্ছিত এবং এর প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য সমাজবাসী ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাতে উদ্যোগী হয় ।
বৈষম্য এবং বিশৃঙ্খলা হতে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। সমাজের প্রচলিত আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, প্রথা প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণের ব্যতিক্রমই সামাজিক বিশৃঙ্খলা। সামাজিক বিশৃঙ্খলা তখনই দেখা দিবে যখন ব্যক্তির উপর সামাজিক রীতিনীতির প্রভাব হ্রাস পাবে। সামাজিক রীতিনীতি যখন ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তখন মানুষের নৈতিক অবনতি শুরু হয়। নৈতিক অবনতি ব্যাপক আকার ধারণ করলে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভাঙন শুরু হয়। সামাজিক প্রতিষ্ঠানের ভাঙনের ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেখা দেয়। এসব পরিস্থিতিতে সমাজে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হতে থাকে।সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হলো— অপরাধ, কিশোর অপরাধ, মাদকাসক্তি, অপহরণ, আত্মহত্যা, নারী নির্যাতন, বিবাহ বিচ্ছেদ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ঘুষ, ছিনতাই, সন্ত্রাস, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতি, যৌন আচরণ, যৌনব্যাধির প্রাদুর্ভাব, স্বেচ্ছাচার, শিশুশ্রম, শিশুদের প্রতি অবহেলা, হত্যা প্রভৃতি ।
সামাজিক নৈরাজ্যের ধারণা
বাংলাদেশ সামাজিক বিশৃঙ্খলার চরম রূপ হচ্ছে সামাজিক নৈরাজ্য। রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র যখন আর কাজ করে না এবং শাসনযন্ত্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তখন সমাজে নৈরাজ্য দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ ঘুষ, নারী নির্যাতন, অপহরণ, যৌন আচরণ ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়।
সামাজিক নৈরাজ্যের কারণ
সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির পিছনে বহু কারণ দায়ী। সামাজিক মূল্যবোধের যথাযথ অনুশীলন সুন্দর সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। সমাজে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ও শিথিলতা ঘটলে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। তাছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও অবহেলা সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। সমাজের সংস্কৃতি পরিপন্থি কর্মকাণ্ড, অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি প্রভৃতির কারণে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়।
সামাজিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের ধারণা
যে কোনো সমাজের রীতিনীতি, মনোভাব এবং সমাজের অন্যান্য অনুমোদিত আচার-আচরণের সমন্বয়ে সামাজিক মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। বস্তুত যেসব ধ্যানধারণা, বিশ্বাস, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সংকল্প মানুষের আচার-আচরণ এবং কার্যাবলিকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলোর সমষ্টিই হলো মূল্যবোধ। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো, অতিথির প্রতি সম্মান প্রদর্শন, ছোটদের প্রতি স্নেহ, মায়া-মমতা প্রভৃতি সামাজিক মূল্যবোধের উদাহরণ। এসব মূল্যবোধের অবনতিই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় সামাজিক অসঙ্গতি ।
সামাজিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের কারণ
সমাজ পরিবর্তনের সাথে মূল্যবোধ পরিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। সমাজে যখন শিক্ষা উন্নয়ন, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে তখন মূল্যবোধেরও পরিবর্তন ঘটে। মূল্যবোধের এই পরিবর্তন ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয়ই হতে পারে। মূল্যবোধের ইতিবাচক পরিবর্তন সমাজ অনুমোদিত। মূল্যবোধের নেতিবাচক পরিবর্তন সমাজ অনুমোদিত নয়। এটি মূল্যবোধের অবক্ষয়।
সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অভাব দেখা দিলেও সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা অসঙ্গতি বেড়ে যায়। ফলে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটবে। তাছাড়া সমাজে আইনের শাসনের দুর্বলতা ও অভাব, মানুষের সহনশীলতার অভাব এবং বিশৃঙ্খল পরিবেশের কারণেও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। ধর্মীয় অপব্যাখ্যাও মানুষকে মূল্যবোধহীন পথে পরিচালিত করতে পারে, যেমন—কোনো বিষয়ে মনগড়া ফতোয়াজারির মাধ্যমে দোররা মারা মূল্যবোধ পরিপন্থি কাজ ।
সামাজিক নৈরাজ্য ও মূল্যবোধ অবক্ষয়ের প্রভাব
সমাজ জীবনে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও মূল্যবোধ অবক্ষয়ের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈরাজ্যপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে মানুষের অধিকারের বঞ্চনা বেড়ে যায় ঘুষ,দুর্নীতিতে গোটা সমাজ অচল হয়ে পড়ে। অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ অপরাধী শাস্তি পায় না। সমাজ জীবনে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দেশের সকল সেবা খাতের মান নিম্নগামী হয়। সমাজে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা বেড়ে যায়।
নারীর প্রতি সহিংসতা
নারীর প্রতি সহিংসতার ধারণা
পুরুষ বা নারী কর্তৃক যে কোনো বয়সের নারীর প্রতি শুধু নারী হওয়ার কারণে যে সহিংস আচরণ করা হয় তাই নারীর প্রতি সহিংসতা। কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি নানা অজুহাতে নারীর আর্থ-সামাজিক, শারীরিক কিংবা মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটিয়ে থাকে। নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক বা মানসিকভাবে এই নির্যাতন চালানো হয়। এ সহিংস আচরণ বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্র, হাট-বাজার থেকে শুরু করে যে কোনো স্থানে ঘটতে পারে।
নারীর প্রতি সহিংসতার প্রকৃতি
বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা নারীর স্বাধীনতা এবং ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক। নারীর প্রতি সহিংসতার নানা প্রকৃতি রয়েছে। নারীরা বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক যেসব নির্যাতনের শিকার হয় তাকে বলে পারিবারিক সহিংসতা। সাধারণত স্বামী, শাশুড়ি, ননদ এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্য দ্বারা নারী এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। এসব সহিংসতার মধ্যে রয়েছে প্রহার, যৌতুক সম্পর্কিত নির্যাতন, শিক্ষা ও সম্পত্তির অধিকারের বঞ্চনা, অত্যধিক কাজের বোঝা চাপানো, কন্যা শিশুকে মারধর, নিপীড়ন প্রভৃতি ।
যৌন হয়রানি, নির্যাতন ও ধর্ষণ, মনগড়া ফতোয়া, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু পাচার প্রভৃতি হলো বর্বর, নির্মম ও পৈশাচিক সহিংসতা।
যৌন হয়রানি :
সাম্প্রতিক সময়ে যৌন হয়রানি বাংলাদেশের অন্যতম সামাজিক সমস্যা। এটি নৈতিকতার চরম অবক্ষয়, একটি সামাজিক বিপর্যয়। নারীরা বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। বর্তমানে কিশোরী, তরুণী এমনকি বিবাহিত নারীও জঘন্য যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। যৌন হয়রানিকে ইভটিজিংও (Eveteasing) বলা হয়। ইভটিজিং শব্দটি যৌন হয়রানির ইংরেজি প্রতিশব্দ। ইভটিজিং হচ্ছে লোকসমাগমপূর্ণ স্থানে পুরুষ কর্তৃক নারীদের নিগ্রহ বা উত্ত্যক্ত করা। গৃহঅভ্যন্তরে, কর্মক্ষেত্রে অথবা যাতায়াতের পথে, কখনোবা নিরিবিলি স্থানে অসৎ উদ্দেশ্যে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পুরুষ কর্তৃক নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হয়। অনেক সময় শিশুরাও যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
ফতোয়া : গ্রামীণ এলাকায় মনগড়া ফতোয়ার মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হয়। কখনো কখনো গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ মনগড়া আইনের মাধ্যমে বিচারকার্য পরিচালনা করে। এসব দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী।
এসিড নিক্ষেপ : এসিড নিক্ষেপ নারীর প্রতি একটি ভয়াবহ সহিংসতা। বর্তমানে বাংলাদেশে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত নারীদের উপরই এসিড নিক্ষেপের ঘটনা অধিক ঘটে থাকে। প্রেম ও অনৈতিক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক কলহসহ নানা কারণে এসিড নিক্ষেপের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে।
নারী ও শিশু পাচার : নারী ও শিশুরা পাচার হয়ে নানাভাবে সহিংসতার শিকার হয় । দক্ষিণ এশিয়ায় নারী ও শিশু পাচারের পরিস্থিতি ভয়াবহ। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর নারী ও শিশু পাচার হয়ে যায়। এদের বলপূর্বক বিভিন্ন অবমাননাকর এবং অমানবিক কাজ, যেমন- দেহ ব্যবসায়, উটের জকি ইত্যাদিতে ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় এসব পাচারকৃত নারী ও শিশুদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও বিক্রি করা হয়।
নারীর প্রতি সহিংসতার কারণ
সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার বহু কারণ রয়েছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্ন কাজে নারী সর্বদা অপারদর্শী অদক্ষ হিসেবে পরিগণিত হয়। বাইরের বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত রাখা, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, ক্রমাগত কন্যা সন্তানের জন্ম ও এর ফলে পুত্রসন্তানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠা প্রভৃতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলছে। প্রকৃত শিক্ষার অভাব এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থা আমাদের দেশে যৌতুক প্রথাকে প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করেছে। ক্রমে যৌতুকপ্রথা পরিণত হয়েছে সহিংসতার হাতিয়ার রূপে। তাছাড়া নারীকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা, মতলবি ফতোয়া, বিভিন্ন সামাজিক কুপ্রথা প্রভৃতি নারীর প্রতি সহিংসতার গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
এখনও আমাদের সমাজে অনেক পুরুষ নারীকে দুর্বল ও অবলা হিসেবে মনে করে। গ্রামীণ ও শহুরে সমাজের কতিপয় পরিবারে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি হলো নারীর কাজ গৃহে রান্না-বান্না, সন্তান জন্মদান, লালন-পালন, সবজি বাগান করা, গবাদিপশু পালন, শিশুকে পাঠদান, শারীরিক শুশ্রুষা করা প্রভৃতি।পুরুষতান্ত্রিক অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি, যেমন- পুরুষ নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, নারীরা স্বামীর সেবাদাসী, স্বামীর পদতলে স্ত্রীর বেহেস্ত প্রভৃতি মনোভাব থেকেই নারীর প্রতি সহিংসতার সৃষ্টি হয়। আবার শৈশবে নিজ পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বঞ্চনার অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে একজন পুরুষকে সহিংস করে তুলতে পারে। কন্যা সন্তানকে শিক্ষা দানের প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া, কন্যা সন্তানের প্রতি মা-বাবার উদাসীনতা, পুত্র সন্তানকে প্রাধান্য দেওয়া, বিবাহে কন্যার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে উপেক্ষা করার মনোভাব প্রভৃতি নারীর প্রতি সহিংসতাকে আরও একধাপ বাড়িয়ে দেয় ৷
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইনি প্রতিকার
১. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ :
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (২০০৩ সালে সংশোধিত) যৌন হয়রানিকে শাস্তিমূলক অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে—’যদি কোনো পুরুষ অযাচিতভাবে তার যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্য নারীর শালীনতা অবমাননা কিংবা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি বা ইঙ্গিতের মাধ্যমে যৌন হয়রানিমূলক আচরণ ঘটায় তবে উক্ত ব্যক্তি অনূর্ধ্ব সাত বছর এবং সর্বনিম্ন দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
২. এসিড অপরাধ দমন আইন-২০০২ :
এসিড অপরাধ দমন আইনে এসিড দ্বারা মৃত্যু ঘটানো, এসিড দ্বারা আহত করা, এসিড নিক্ষেপ করা বা নিক্ষেপের চেষ্টা করা এবং এ অপরাধে সহায়তা করা প্রভৃতির শাস্তি, বিচার পদ্ধতি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এসিড দ্বারা মৃত্যু ঘটানোর শাস্তি : যদি কোনো ব্যক্তি এসিড দ্বারা অন্য কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটান তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
2এসিড দ্বারা আহত করার শাস্তি :
এই আইনে আরও বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এসিড দ্বারা কাউকে এমনভাবে আহত করেন যে- ক. তার দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নষ্ট হয় বা মুখমণ্ডল বিকৃত বা নষ্ট হয় তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকার অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। খ. শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ, গ্রন্থি বা অংশ বিকৃত বা নষ্ট হয় বা শরীরের কোনো স্থান আঘাতপ্রাপ্ত হয় তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক চৌদ্দ বছর কিন্তু অন্যূন সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব পঞ্চাশ হাজার টাকার অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। এছাড়া এসিড নিক্ষেপ করা বা নিক্ষেপের চেষ্টা বা অপরাধে সহায়তা করার জন্যও শাস্তির বিধান রয়েছে। এসিড নিয়ন্ত্রণ আইনে সরকার এসিডের মজুদ, বহন, আনা-নেওয়া ব্যবস্থা ইত্যাদির ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক এসিড নিয়ন্ত্রণ (সংশোধন) আইন-২০১০ পাস হয়।
৩. নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের আইন :
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এ বলা হয়েছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি পতিতাবৃত্তি বা বেআইনি বা নীতিগর্হিত কোনো কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে কোনো নারী বা শিশুকে বিদেশ থেকে আনয়ন করেন বা বিদেশে পাচার বা প্রেরণ করেন অথবা ক্রয় বা বিক্রয় করেন বা অনুরূপ কোনো উদ্দেশ্যে কোনো নারী ও শিশুকে তার দখলে বা হেফাজতে রাখেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ বছর কিন্তু অন্যূন ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। এছাড়াও নারী ও শিশু অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু, যৌনপীড়ন, যৌতুকের জন্য মৃত্যু ঘটানো ইত্যাদির ক্ষেত্রে আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে।
শেষ কথা
আশা করছি এই পোস্ট আপনাদের ভালোলেগেছে এবং এখান থেকে বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এই ওয়েবসাইটে শিক্ষা সংক্রান্ত পোস্ট শেয়ার করা হয়। বিভিন্ন শ্রেণির প্রশ্ন সমাধান ও উত্তর পেতে আমার সাথেই থাকুন।
আরও দেখুনঃ
৮ম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় ৯ম অধ্যায় MCQ প্রশ্ন উত্তর
One Comment on “বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যা ৮ম শ্রেণি দশম অধ্যায়”