বাাংলাদেশঃ রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশ ও বিশবপরিচয় ৮ম শ্রেণি

বাাংলাদেশঃ রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা

একটি দেশের মূল কাঠামো হচ্ছে দেশের সরকার। শুধু বাংলাদেশ নেয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশ সরকার দ্বারা পরিচালিত। সরকারই পারে একটি দেশ কে উন্নয়নের পস্থে এগিয়ে নিতে। সরকার দেশের সকল আইন বিভাগ ও মন্ত্রী পরিষদ পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে। সাংবিধানিক ভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সংসদীয় পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ পদমর্যাদার অধিকারী হলেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি হওয়ার ন‍্যূনতম বয়স ৩৫ বছর। জাতীয় সংসদ সদস্যদের ভোটে তিনি নির্বাচিত হন। স্পিকার  রাষ্ট্রপতিকে শপথ বাক্য পাঠ করান।  এই পোস্টে ৮ম শ্রেণির ৬ ষষ্ঠ অধ্যায়ের বাাংলাদেশঃ রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

বাাংলাদেশঃ রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা

রাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান । সরকার রাষ্ট্র গঠনের একটি উপাদান। পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নিজস্ব সরকার ব্যবস্থা রয়েছে। সরকার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। আবার প্রতিটি সরকারের রয়েছে কিছু অঙ্গ । এগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্র নানামুখী কাজ করে থাকে। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সংবিধানে উল্লিখিত নীতিমালার ভিত্তিতে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়। এতে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার বিবরণ রয়েছে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি

১৯৭২ সালের মূল সংবিধান এবং সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ হলো:

১. জাতীয়তাবাদ : একই ধরনের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাঙালি জাতির মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য সৃষ্টি করেছে। তাই সংবিধানে বলা হয়েছে, একই ভাষা ও সংস্কৃতিতে আবদ্ধ বাঙালি জাতি যে ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে সেই ঐক্য ও সংহতি হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি

২. সমাজতন্ত্র : অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতা আনার মাধ্যমে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাই হলো সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য। শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রের একটি মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে।

৩. গণতন্ত্র : রাষ্ট্রের সকল কাজে নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই হলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলনীতি। এর মাধ্যমে নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে; মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে ।

৪. ধর্ম নিরপেক্ষতা : রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে এবং ধর্ম পালনে কেউ কাউকে বাধা প্রদান করবে না- এই লক্ষ্য সামনে রেখে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। উল্লিখিত মূলনীতিগুলো রাষ্ট্র পরিচালনার সকল ক্ষেত্রে অনুসৃত হয়। প্রতিটি নাগরিকের উচিত এগুলো মেনে চলা। এছাড়া সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার পবিত্র দলিল। অতএব, সংবিধানকে সম্মান করা ও তা মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য।

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য

সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল। একটি ভবন বা ইমারত যেমন এর নকশা দেখে তৈরি করা হয়, তেমনি সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সরকার কী ধরনের হবে, নাগরিক হিসাবে আমরা কী অধিকার ভোগ করব, সরকারের বিভিন্ন বিভাগ কী ক্ষমতা ভোগ করবে তার সবকিছুই এতে লিপিবদ্ধ থাকে। বাংলাদেশের সংবিধান রচনার ইতিহাস :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ই এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে এবং ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ছয় মাসের মধ্যে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করে। ১৯৭২ সালের ৩০শে অক্টোবর গণপরিষদে এটি আলোচিত হয়। অবশেষে একই বছরের ৪ঠা নভেম্বর গণপরিষদে এটি চূড়ান্ত অনুমোদন পায় ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতে, “এই সংবিধান লিখিত হয়েছে লাখো শহিদের রক্তের অক্ষরে” । তাই এটি আমাদের সবার কাছে একটি পবিত্র দলিল হিসাবে গণ্য।

সংবিধান কোনো অপরিবর্তনশীল বিষয় নয়। সময়ের প্রয়োজনে এটি পরিবর্তিত এবং সংশোধিত হতে পারে। এ যাবৎ ১৭ বার সংশোধিত হয়েছে। সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী (সপ্তদশ) সংসদে পাস হয় ৮ই জুলাই ২০১৮।

আমাদের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ :

১. গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার : বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত হবে।
২. সংসদীয় পদ্ধতির সরকার : বাংলাদেশে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত বা সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা চালু থাকবে। এই পদ্ধতিতে প্রকৃত শাসন ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকবে।
৩. লিখিত সংবিধান : এটি একটি লিখিত দলিল। যা ১১ ভাগে বিভক্ত এবং এতে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ ও একটি প্রস্তাবনা আছে।
৪. রাষ্ট্রীয় মূলনীতি : সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো : জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
৫. রাষ্টধর্ম : সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্য সকল ধর্ম ও ধর্মের অনুসারীদের সমান মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
৬. জাতি ও জাতীয়তা : বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি নামে পরিচিত হবে এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় হবে ‘বাংলাদেশি’।
৭. এককেন্দ্রিক সরকার : দেশে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত থাকবে।
৮. এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা : সংবিধানে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত ৩০০ জন সংসদ সদস্য ও তাদের দ্বারা নির্বাচিত ৫০ জন মহিলা সংসদ সদস্য নিয়ে এই আইনসভা গঠিত হবে।
৯. মৌলিক অধিকার : সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও তা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
১০. জনগণের সার্বভৌমত্ব : সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই ক্ষমতা পরিচালনা করবে।
১১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
১২. সর্বজনীন ভোটাধিকার সংবিধানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ১৮ বছর থেকে তদুর্ধ বয়সের সকল নাগরিককে ভোটাধিকার প্রদান করা হয়েছে ।
১৩. নির্বাচন অনুষ্ঠান : মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে ।
১৪. সংবিধান সংশোধন : সংসদ সদস্যদের মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে সংবিধান সংশোধন করা যাবে।

বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ ও কাজ

সরকার রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি। সরকারের মাধ্যমেই রাষ্ট্র যাবতীয় কাজ সম্পাদন করে। সরকার ছাড়া রাষ্ট্র চলতে পারে না। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার বিভিন্ন কাজ করে। যেমন, নাগরিক হিসাবে আমাদের জন্য খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। জনগণের অধিকার ও কল্যাণের জন্য আইন প্রণয়ন করে। কেউ সে আইন অমান্য করলে শাস্তির ব্যবস্থা করে। এ ধরনের আরও অনেক কাজ আছে যা সরকার করে থাকে। সরকারের এ কাজগুলো সম্পাদনের জন্য তিনটি বিভাগ রয়েছে। এগুলো হলো:

(১) আইন বিভাগ
(২) শাসন বিভাগ
(৩) বিচার বিভাগ ।

আইন বিভাগ :

বাংলাদেশের আইনসভা এক কক্ষবিশিষ্ট। এর নাম জাতীয় সংসদ। মোট ৩৫০ জন সদস্য নিয়ে এটি গঠিত। এর মধ্যে ৩০০ জন সদস্য দেশের ৩০০ টি নির্বাচনি এলাকা থেকে নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। বাকি ৫০টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা তাঁরা নির্বাচিত হয়ে থাকেন। অর্থাৎ সংরক্ষিত আসনের মহিলা সাংসদগণ পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। তবে ৩০০টি নির্বাচনি এলাকার যে কোনো আসনে মহিলারা সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নির্বাচিত হতে পারেন।

জাতীয় সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর। একজন স্পিকার জাতীয় সংসদের অধিবেশন সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ডেপুটি স্পিকার তাঁকে এ কাজে সহায়তা করেন। এছাড়া স্পিকারের অনুপস্থিতিতে তিনি সংসদ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। দুজনই সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে ভোটে নির্বাচিত হন ।

আইন সভা বা জাতীয় সংসদ রাষ্ট্রের সাধারণ আইন তৈরি ও পরিবর্তন করে; দেশের জনমতকে প্রকাশ করে; সরকারের আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে; সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধন করে। রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে আইন বিভাগ তা বিচার বিবেচনা করে। এছাড়া দেশের জাতীয় তহবিলের অভিভাবক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। জাতীয় বাজেট অনুমোদন ও কর ধার্য করে ।

শাসন বিভাগ :

রাষ্ট্রের শাসন সংক্রান্ত কার্যাবলি পরিচালনার দায়িত্ব শাসন বিভাগের। ব্যাপক অর্থে, শাসন বিভাগ বলতে রাষ্ট্রের শাসন কাজে নিয়োজিত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বোঝায়। এ অর্থে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে গ্রামের একজন চৌকিদার পর্যন্ত সকলেই শাসন বিভাগের অংশ। তবে প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, মন্ত্রিপরিষদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়েই শাসন বিভাগ গঠিত। শাসন বিভাগ আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত আইন বাস্তবায়ন করে এবং সে অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করে। দেশের অভ্যন্তরে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে এবং বিদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে ।

বিচার বিভাগ :

সরকারের যে অঙ্গ বা বিভাগ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান ও আইন অনুযায়ী বিচার কাজ পরিচালনা করে থাকে তাকে বলা হয় বিচার বিভাগ। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিচারালয়ের বিচারকদের নিয়ে এ বিভাগ গঠিত। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ স্তর হলো সুপ্রিম কোর্ট। এর প্রধানকে ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ বলা হয়। রাষ্ট্রপতি তাঁকে নিয়োগ দেন। সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে দুইটি বিভাগ। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ। এই দুইটি বিভাগের বিচারপতিগণ ও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে বিচার কাজ পরিচালনা করে থাকেন ।

দুষ্টের দমন, অপরাধীর শাস্তি বিধান ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে নাগরিক জীবনকে সুন্দর ও সহজ করে তোলে। বিভিন্ন দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা মোকদ্দমার মীমাংসামূলক রায় দেয়। সংবিধানের বিভিন্ন ধারা বা আইনের ব্যাখ্যা দেয়। দেশের সংবিধান ও নাগরিক অধিকার রক্ষা করে এবং বিভিন্ন ধরনের তদন্তমূলক কাজ করে । উপরের আলোচনায় আমরা লক্ষ করেছি যে, সরকারের প্রতিটি বিভাগের নিজস্ব কাজ ও পরিধি আছে। সে অনুযায়ী বিভাগগুলো পরিচালিত হয়। সকল বিভাগের সম্মিলিত রূপই হলো সরকার এবং সকল বিভাগের কাজ সরকারি কাজের অন্তর্ভুক্ত।

স্থানীয় সরকার কাঠামো ও কার্যাবলি

সাধারণভাবে স্থানীয় সরকার হলো স্থানীয় পর্যায়ে শাসন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা। স্থানীয় সমস্যা স্থানীয়ভাবে সমাধানের লক্ষ্যেই মূলত স্থানীয় সরকার কাজ করে।বর্তমানে রাষ্ট্রের আয়তন বড় ও লোকসংখ্যা বেশি হওয়ায় কেন্দ্রে বসে সরকারের পক্ষে দেশের সকল অঞ্চলের সকল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ কমে স্থানীয় সমস্যার সমাধানও সহজ হয়। এটি বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বাংলাদেশে গ্রাম ও শহরাঞ্চল উভয় ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার কাঠামো বিকশিত হয়েছে। পাশের ছকে উভয় অঞ্চলের স্থানীয় সরকারের কাঠামো দেখানো হলো।বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে তিন স্তরবিশিষ্ট স্থানীয় সরকার কাঠামো চালু আছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন স্তর হলো ইউনিয়ন পরিষদ। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে আছে উপজেলা পরিষদ এবং জেলা পর্যায়ে আছে জেলা পরিষদ।শহরাঞ্চলের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দুই ধরনের-পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশন। আটটি (০৮টি) বিভাগীয় শহর ছাড়াও কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে সিটি কর্পোরেশন রয়েছে এবং পৌরসভাগুলো অন্যান্য শহর এলাকায় স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব পালন করে।

স্থানীয় সরকারের গঠন

একমাত্র জেলা পরিষদ ছাড়া স্থানীয় সরকারের অন্য সকল কাঠামোর নেতৃত্বই নির্বাচিত হন জনগণের সরাসরি ভোটে। এগুলোর প্রতিটিরই কার্যকাল পাঁচ বছর।

ইউনিয়ন পরিষদ :

স্থানীয় সরকারের প্রাথমিক স্তর হলো ইউনিয়ন পরিষদ। দেশে বর্তমানে ৪,৫৭১ টি ইউনিয়ন পরিষদ আছে। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একেকটি ইউনিয়ন গঠিত। ইউনিয়ন পরিষদ হলো গ্রামীণ এলাকার স্থানীয় সরকার। গ্রামীণ সমস্যা দূরীকরণ ও স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের বিকাশ ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি এর মূল লক্ষ্য। নির্বাচিত ১ জন চেয়ারম্যান, ৯টি ওয়ার্ড থেকে ৯ জন সদস্য ও সংরক্ষিত আসনে তিন জন মহিলা সদস্যসহ সর্বমোট ১৩ জন নিয়ে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত। (উৎস : স্থানীয় সরকার বিভাগ)

উপজেলা পরিষদ :

কয়েকটি ইউনিয়ন নিয়ে একটি উপজেলা গঠিত হয়। একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইস চেয়ারম্যান, একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং উপজেলার অন্তর্ভুক্ত সব ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং সকল মহিলা সদস্যের এক তৃতীয়াংশকে নিয়ে উপজেলা পরিষদ গঠিত হয়। দেশে বর্তমানে মোট উপজেলা পরিষদের সংখ্যা ৪৯২টি।

জেলা পরিষদ :

কয়েকটি উপজেলা নিয়ে একটি জেলা গঠিত। দেশে ৬৪টি জেলা পরিষদের মধ্যে ৬১টি স্থানীয় সরকার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে। খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি এই তিনটি জেলা পরিষদ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে। একজন চেয়ারম্যান এবং ২০ জন সদস্য নিয়ে জেলা পরিষদ গঠিত। ২০ জন সদস্যের মধ্যে পাঁচ জন হবেন মহিলা।

চেয়ারম্যানসহ সকলে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন। জেলার অন্তর্গত সব মেয়র ও কাউন্সিলর, সব উপজেলার চেয়ারম্যান, সব পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর এবং সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ তাঁদের নির্বাচিত করেন। জেলার অন্তর্ভুক্ত সংসদ সদস্যগণ হবেন জেলা পরিষদের উপদেষ্টা।

পৌরসভা :

শহর এলাকার স্থানীয় সরকার হিসাবে পৌরসভা গঠিত। বর্তমানে দেশে ৩২৭টি পৌরসভা আছে। একজন মেয়র, প্রতি ওয়ার্ড থেকে একজন করে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলরদের নিয়ে পৌরসভা গঠিত হয়। আয়তন ও জনসংখ্যার তারতম্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন পৌরসভার সদস্য সংখ্যা কম বা বেশি হতে পারে।

সিটি কর্পোরেশন :

বাংলাদেশে ১২টি সিটি কর্পোরেশন আছে। ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ। প্রতিটিতে আছে একটি করে সিটি কর্পোরেশন। সিটি কর্পোরেশনের প্রধানকে বলা হয় মেয়র। মেয়রের কাজে সাহায্যের জন্য আছে কাউন্সিলর। সিটি কর্পোরেশনের আয়তনের ভিত্তিতে কাউন্সিলরদের সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে।

স্থানীয় সরকারের কাজ

স্থানীয় সরকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত ব্যবস্থা। এটি তাত্ত্বিক অর্থেও সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণমুক্ত। জনহিতকর কাজ থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে স্থানীয় সরকার। স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নের মূল দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে।

ইউনিয়ন পরিষদের কাজ

এলাকার উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদ অনেক দায়িত্ব পালন করে। যেমন :

  1. • ইউনিয়নের সার্বিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন ।
  2. • বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ।
  3. • ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ।
  4. • ইউনিয়নের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা ।
  5. • প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা ।
  6. • পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপকরণ সহজলভ্য করার ব্যবস্থা ।
  7. • গরিব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান, বয়স্কদের শিক্ষাদান, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ইত্যাদির ব্যবস্থা।
  8. • এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ।
  9. • এলাকায় জমির খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা।
  10. • এলাকায় কোনো অপরাধ বা দুর্ঘটনা ঘটলে পুলিশকে জানানো এবং অপরাধের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টি।
  11. • বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা যেমন : যৌন হয়রানি, যৌতুক প্রথা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক কাজ করা।
  12. • এলাকায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য বিবাদ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা।

উপজেলা পরিষদের কাজ :

উপজেলা পরিষদের কাজ অনেকাংশে ইউনিয়ন পরিষদের কাজের মতো। এছাড়া উপজেলা পরিষদ পাঁচশালাসহ বিভিন্ন মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করে। সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, তত্ত্বাবধান ও তার সমন্বয় সাধন করে। বিভিন্ন ইউনিয়নের মধ্যে সংযোগকারী রাস্তা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে।

জেলা পরিষদের কাজ

জেলার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনা করাই জেলা পরিষদের কাজ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: উপজেলা ও পৌরসভার সংরক্ষিত এলাকার বাইরে রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, আবাসিক হোস্টেল তৈরি, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, অনাথ আশ্রম নির্মাণ, গ্রন্থাগার তৈরি ও নৈশ বিদ্যালয় পরিচালনা, কৃষি খামার স্থাপন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ এবং পানি সেচের ব্যবস্থা করা । এছাড়াও জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণের কাজ এবং জেলার যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নেও কাজ করে ।

পৌরসভার কাজ
  1. বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা ।
  2. স্বাস্থ্যকর ও ভেজালমুক্ত খাদ্য বিক্রি নিশ্চিত করা ।
  3. শহরের পরিবেশ রক্ষার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা ।
  4. বিধি মোতাবেক ঘরবাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করা ।
  5. সড়ক নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা।
  6. রাস্তার দুই পাশে গাছ লাগানো, পার্ক ও উদ্যান প্রতিষ্ঠা ও উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ সংরক্ষণ করা।

তাছাড়া পৌরসভা বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, এতিম ও দুঃস্থদের জন্য এতিমখানা পরিচালনা, লাইব্রেরি ও ক্লাব গঠন করা। ভিক্ষাবৃত্তি নিরোধ, খেলাধুলার ব্যবস্থা, মিলনায়তন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, জন্ম-মৃত্যু ও বিবাহ-নিবন্ধন, মহামারী ও সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্ৰণ ও বিশিষ্ট অতিথিদের অভ্যর্থনা প্রদানের ব্যবস্থা করাও পৌরসভার কাজ।

সিটি কর্পোরেশনের কাজ :
  1. বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা ।
  2. স্বাস্থ্যকর ও ভেজালমুক্ত খাদ্য বিক্রি নিশ্চিত করা ।
  3. শহরের পরিবেশ রক্ষার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা ।
  4. সুষ্ঠুভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণের ব্যবস্থা করা ।
  5. সড়ক নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা ; রাস্তার দুই পাশে গাছ লাগানো, পার্ক ও উদ্যান প্রতিষ্ঠা ও উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ সংরক্ষণ করা ইত্যাদি ।

প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশের সরকারপ্রধান অথবা মন্ত্রিপর্ষদের প্রধান হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে। এই পদ ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রীদিগকেও নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। যে সংসদ-সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন হিসেবে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হবেন, রাষ্ট্রপতি তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে হলে বয়স ন‍্যূনতম ২৫ বছর হতে হবে। জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রী যিনি প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

শেষ কথা

সরকার ব্যাতিত আরও অন্যান্য পদ রয়েছে। প্রতি মন্ত্রী বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা লোক নির্বাচন করা হয়। আশা করছি এই পোস্ট আপনাদের ভালোলেগেছে এবং এখান থেকে বাাংলাদেশঃ রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা  সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এই ওয়েবসাইটে শিক্ষা সংক্রান্ত পোস্ট শেয়ার করা হয়। বিভিন্ন শ্রেণির প্রশ্ন সমাধান ও উত্তর পেতে আমার সাথেই থাকুন।

আরও দেখুনঃ

৮ম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় ৬ষ্ঠ অধ্যায় বহুনির্বাচনি প্রশ্ন উত্তর

৮ম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় সৃজনশীল প্রশ্ন ৬ষ্ঠ অধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *