নদীর স্বপ্ন কবিতা- বুদ্ধদেব বসু। বাংলা ১ম পত্র ৮ম শ্রেণি

নদীর স্বপ্ন কবিতা

এই পোস্টে বুদ্ধদেব বসু এর নদীর স্বপ্ন কবিতা টি দেওয়া আছে। বুদ্ধদেব বসুর ‘নদীর স্বপ্ন’ কবিতায় নদী এবং নৌকা ভ্রমণ নিয়ে এক কিশোরের কল্পনা রূপায়িত হয়েছে। দুরন্ত এক কিশোর তার ছোট বোনকে নিয়ে নৌকাতে ওঠে তার মনের সাধ পূরণ করতে চায়। নদীর চারপাশের মনোরম দৃশ্যে তার মনে গভীর স্বপ্ন আসে। তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয় নৌকায় চড়ে এক নদী থেকে আরেক নদী দেখার মাধ্যমে। নিচের অংশে কবিতা, নদীর স্বপ্ন কবিতার মূলভাব ও নদীর স্বপ্ন কবিতার ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।

নদীর স্বপ্ন কবিতা
বুদ্ধদেব বসু

কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না! দুটো কথা শোনা দিকি
এই নাও- এই চকচকে ছোটো, নুতন রূপোর সিকি
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে, তোমারে দেবো গো তা-ও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে নৌকায় তুলে নাও।

নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে- যাবে কি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো মোরে আর ছোকানুরে
আমারে চেনো না? মোর নাম খোকা, ছোকানু আমার বোন
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা মেঘনা-পদ্মা-শোন।

দিদি মোরে ডাকে গোবিন্দচাঁদ, মা ডাকে চাঁদের আলো,
মাথা খাও, মাঝি, কথা রাখো! তুমি লক্ষী, মিষ্টি, ভালো!
বাবা বলেছেন, বড় হয়ে আমি হব বাঙলার লাট,
তখন তোমাকে দিয়ে দেব মোর ছেলেবেলাকার খাট।

চুপি-চুপি বলি, ঘুমিয়ে আছে মা, দিদি গেছে ইস্কুলে,
এই ফাঁকে মোরে-আর ছোকানুরে- নৌকোয়া লও তুলে।
কোন ভয় নেই – বাবার বকুনি তোমাকে হবে না খেতে
যত দোষ সব, আমার- না, আমি একা ল’ব মাথা পেতে।

নৌকো তোমার ডুবে যাবে নাকো, মোরা বেশি ভারি নই,
কিচ্ছু জিনিস নেবো না সঙ্গে কেবল ঝন্টু বই।
চমকালে কেন! ঝন্টু পুতুল, ঝন্টু মানুষ নয়,
একা ফেলে গেলে, ছোকানুরে ভেবে কাঁদিবে নিশ্চয়।

অনেক রঙের পাল আছে, মাঝি? বাদামী? সোনালী? লাল?
সবুজও? তা হলে সেটা দাও আজ, সোনালীটা দিয়ো কাল।
সবগুলো নদী দেখাবে কিন্তু। আগে চলো পদ্মায়,
দুপুরের রোদে রূপো ঝলমল সাদা জল উছলায়

শুয়ে’ শুয়ে’ – মোরা দেখিব আকাশ- আকাশ ম-স্ত বড়,
পৃথিবীর যত নীল রঙ- সব সেখানে করেছে জড়।
মায়ের পূজোর ঘরটির মত, একটু ময়লা নাই,
আকাশেরে কে যে ধোয় বারবার, তুমি কি জানো তা ভাই?

কালো-কালো পাখি বাঁকা ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলে যায় দূরে,
উঁচু থেকে ওরা দেখিতে কি পায় মোরে আর ছোকানুরে?
রূপোর নদীতে রূপোর ইলিশ- চোখ ঝলসানো আঁশ,
ওখানে দ্যাখো না- জালে বেঁধে জেলে তুলিয়াছে একরাশ।

ওটা চর বুঝি? একটু রাখো না, এ তো ভারি সুন্দর।
এ যেন নতুন কার্পেট বোনা! এই পদ্মার চর?
ছোকানু, চল রে, চান ক’রে আসি দিয়ে সাত-শোটা ডুব,
ঝাঁপায়ে-দাপায়ে টলটলে জলে নাইতে ফুর্তি খুব।

ইলিশ কিনলে? আঃ, বেশ বে তুমি খুব ভালো, মাঝি
উনুন ধরাও ছোকানু দেখাবে রান্নার কারসাজি।
খাওয়া হ’লো শেষ- আবার চলেছি, দুলছে ছোট্ট নাও,
হাল্কা নরম হাওয়ায় তোমার লাল পাল তুলে দাও।

আমর দু’জন দেখি ব’সে ব’সে আকাশ কত না নীল,
ছোট পাখি আরো ছোট হ’য়ে যায়- আকাশের মুখে তিল
সারাদিন গোলা, সূর্য লুকালো জলের তলার ঘরে,
সোনা হ’য়ে জ্বলে পদ্মার জল কালো হ’লো তার পরে।

সন্ধ্যার বুকে তারা ফুটে ওঠে- এবার নামাও পাল
গান ধরো, মাঝি; জলের শব্দ ঝুপঝুপ দেবে তাল।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে- আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হ’লে আমায় অনেক গল্প বলবে, মাঝি?

শুনতে-শুনতে আমিও ঘুমাই বিছানা বালিশ বিনা
– মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে, ভাই, ও বড়োই ভীতু কিনা
আমার জন্য কিচ্ছু ভেবো না, আমিই তো বড়োই প্রায়,
ঝড় এলে ডেকো আমারে- ছোকানু যেন সুখে ঘুম যায়।

নদীর স্বপ্ন কবিতার পাঠ পরিচিতি

বুদ্ধদেব বসুর ‘নদীর স্বপড়ব’ কবিতায় নদী এবং নৌভ্রমণ নিয়ে এক কিশোরের কল্পনা রূপায়িত হয়েছে। দুরমত এক কিশোর তার ছোট বোনকে নিয়ে নৌকাতে উঠে নদীর পর নদী পার হয়ে তাদের মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চায়। নৌকার নানা রঙের পাল, নীল রঙের আকাশ, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির উড়ে চলা, রূপলি ইলিশ মাছ, নৌকায় রান্না করা, সন্ধ্যায় গান গাওয়া, গল্পকরা-এত কিছু কিশোর মনে গভীর স্বপ্ন নিয়ে আসে। পাশাপাশি বোনের প্রতি ভাইয়ের দায়িত্ব ও আদর প্রকাশের চমৎকার নিদর্শন আছে।

নদীর স্বপ্ন কবিতার কবি পরিচিতি

বুদ্ধদেব বসু বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি কবিতা, ছড়া, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণ-কাহিনি, স্মৃতিকথা, অনুবাদ, সম্পাদনা ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক (সম্মান) এবং পরের বছর প্রথম শ্রেণিতেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রথমে সাংবাদিকতা এবং পরে অধ্যাপনাকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে তাঁর ও অজিত দত্তের যৌথ সম্পাদনায় সচিত্র মাসিক পত্রিকা ‘প্রগতি’ (১৯২৭-১৯২৯) প্রকাশিত হয়।

তিনি ‘কবিতা পত্রিকা’ নামেও একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যরীতির বাইরে পৃথক কাব্যধারার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কবি বুদ্ধদেব বসুর রচনাশৈলী স্বতন্ত্র ও মনোজ্ঞ। তিনি বহু কবিতা গল্প প্রবন্ধ উপন্যাস নাটক রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন । বদ্ধদেব বসু ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বিক্রমপুর অর্থাৎ বর্তমানের মুন্সিগঞ্জে। ১৯৭৪খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই মার্চ তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

নদীর স্বপ্ন কবিতার শব্দার্থ

  • সিকি – চার আনি মূল্যের মুদ্রা বা ২৫ পয়সার মুদ্রা।
  • আনি – এক টাকার ষোল ভাগের এক ভাগ মূল্যের মুদ্রা।
    শোণ – একটি নদীর নাম।
  • পাল – বাতাসের সাহায্যে চালাবার জন্য নৌকায় খাটানো কাপড়ের পর্দা।
  • কারসাজি – কূটকৌশল। এখানে চমৎকারিত্ব অর্থে কাব্যিক ব্যবহার।
  • সূর্য লুকালো – সূর্য অস্ত গেল।

শেষ কথা

আশা করছি এই পোস্ট টি আপনাদের অনেক ভালোলেগছে এবং এই পোস্ট থেকে নদীর স্বপ্ন কবিতা পিডিএফ সংগ্রহ করতে পেরেছেন। এই রকম শিক্ষামূলক আরও পোস্ট পেতে আমার সাথেই থাকুন। অষ্টম শ্রেণির বাংলা ১ম পত্রের অনেক পোস্ট এই ওয়েবসাইটে শেয়ার করা হয়েছে। পোস্ট টি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আরও দেখুনঃ

রুপাই কবিতা– জসীমউদ্দীন। বাংলা ১ম পত্র অষ্টম শ্রেণি