এখানে ঔপনিবেশিক যুগ ও বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম অধ্যায় টি দেওয়া আছে। এটি ৮ম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের প্রথম অধ্যায়। এখানে এই ঔপনিবেশিক যুগ ও বাংলাদেশের সবাধনাতার কথা ও পূর্বের ইতিহাস দেওয়া আছে। এই অধ্যায় টি একটি ইতিহাসের গল্পের মতো। নিচে থেকে পাঠ্য বইয়ের ইতিসাহ এখান থেকে পড়ুন।
ঔপনিবেশিক যুগ ও বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম
বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের আগমন ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে হলেও পরে তারা আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। এদের মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যায়। ১৭৫৭ সালে বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে তারা ক্ষমতা দখল করে নেয়। বাংলায় ইংরেজদের শাসন চলে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। এভাবে ১৭৫৭ সালের পরে বাংলায় যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় সাধারণত আমরা তাকে ঔপনিবেশিক শাসন বলি। আর ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজ শাসনামলকে ঔপনিবেশিক যুগ বলি ।
বাংলায় ঔপনিবেশিক শাসন
উপনিবেশিকরণ একটি প্রক্রিয়া। সাধারণভাবে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক শোষণ ও লাভের উদ্দেশ্যে এক দেশ অন্য দেশের উপর প্রভুত্ব স্থাপন করে তাকে নিজের দখলে আনে। অধীনস্থ দেশটির জনগণ, সম্পদ সবকিছুই অধিপতি দেশটি নিজের স্বার্থ অনুযায়ী পরিচালনা করে। এখানে দখলকৃত দেশটি দখলকারী দেশের উপনিবেশে পরিণত হয়। বাংলা প্রায় দুইশ বছর এমনভাবে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে ছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এই শাসনের সূচনা হয়েছিল যা নানা আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে শেষ হয় ।
কীভাবে এই ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়েছিল তা জানার আগে সেইসময় বাংলার রাজনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল তা কিছুটা জেনে নেয়া দরকার। বাংলার রাজনৈতিক পটভূমি: ঔপনিবেশিক শাসন-পূর্বকাল প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা অঞ্চলে মানব বসতির কথা জানা যায়। এ অঞ্চলটি বরাবরই ছিল ধনসম্পদে পূর্ণ একটি এলাকা । ফলে ইংরেজ আগমনের অনেক আগে থেকেই এখানে বাইরের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষের আগমন ঘটতে থাকে। সকলের আকর্ষণের প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলার অর্থনৈতিক প্রাচুর্য। কাজেই বহিরাগতের আগমন বাংলার ইতিহাসের নতুন কোনো ঘটনা নয়।
খ্রিষ্টপূর্ব যুগে বহিরাগত আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী বাংলায় প্রবেশ করেছিল । খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বাংলার উত্তরাংশ দখল করেন ভারতের মৌর্য সম্রাট অশোক। সে সময় পুন্ড্রনগর (পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি) হয় মৌর্যদের প্রদেশ। মৌর্যদের পর ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয় গুপ্ত সাম্রাজ্য। চার শতকে উত্তর বাংলা ও দক্ষিণ-পূর্ব-বাংলার কিছু অংশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধিকারে আসে। গুপ্তদের পতনের পর সপ্তম শতকে বাংলার উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে প্রথম বাঙালি শাসক শশাঙ্ক কর্তৃক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
একই সময়ে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় বঙ্গ নামে আরেকটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠেছিল। তার মৃত্যুর পর একশো বছর ধরে বাংলায় অরাজকতা চলতে থাকে। যাকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় মাৎস্যন্যায় যুগ। এরপর বাঙালিদের দীর্ঘস্থায়ী রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় আট শতকের মাঝ পর্বে। প্রায় চারশো বছর বাংলাকে শাসন করেন বাঙালি পাল রাজারা। পালদের পতনের পর এগারো শতকের শেষ দিকে আবার বিদেশি শাসনের অধীনে চলে যায় বাংলা। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক থেকে আসা সেন রাজারা বাংলার সিংহাসন দখল করে নেন।
সেন শাসনের অবসান ঘটে ভাগ্যান্বেষণে আগত তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির হাতে। তিনি রাজা লক্ষ্মণসেনকে পরাজিত করে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। ১২০৪ থেকে ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার পশ্চিমে নদীয়া ও উত্তর বাংলার কিছুটা অংশ বখতিয়ার খলজির দখলে ছিল। নদীয়া ও উত্তর বাংলায় তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলার পূর্বাঞ্চল (বিক্রমপুর) আরও অনেক সময় পর্যন্ত সেন শাসকদের অধীনে ছিল । বিহার অভিযানে ব্যর্থতার পর ১২০৬ সালে বখতিয়ার খলজি মারা যান। তবে তাঁর মাধ্যমে বাংলায় তুর্কি সুলতানদের শাসনের পথ প্রশস্ত হয়েছিল । তারপর ১৩৩৮ সাল পযন্ত বাংলা জুড়ে মুসলিম শাসনের বিস্তার ঘটতে থাকে।
এ সময়ের মধ্যে বাংলার তিনটি অংশে দিল্লি সালতানাতের তিনটি প্রদেশ বা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিভাগগুলো উত্তর বাংলায় লখনৌতি, পশ্চিম বাংলায় সাতগাঁও এবং পূর্ব বাংলায় সোনারগাঁও নামে পরিচিত ছিল । ১৩৩৮ সালে সোনারগাঁওয়ের শাসনকর্তা ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ দিল্লির সুলতানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এভাবে বাংলায় স্বাধীন সুলতানি যুগের সূচনা হয়। তবে সমগ্র বাংলার এক বৃহদাংশ অধিকার করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার মাধ্যমে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলার প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন বলে ধরা হয়। ইলিয়াস শাহ ‘শাহ-ই-বাঙ্গালা’ ও ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’ উপাধি ধারণ করেন ।
স্বাধীন সুলতানি আমলের অপর অন্যতম উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা এবং বাংলা শিল্প, সাহিত্যের বিকাশে তাঁর অবদান অপরিসীম। যাহোক, ১৫৩৮ সালে অবসান ঘটে বাংলার স্বাধীন সুলতানি শাসনের। অবশ্য এর আগেই মোগল শক্তি দিল্লির সিংহাসন দখল করেছিল। মোগল সম্রাট হুমায়ুন ১৫৩৮ সালে উত্তরবাংলার গৌড় অর্থাৎ লখনৌতি দখল করলেও বাংলায় তখন মোগল শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। এর কারণ, বিহারের আফগান শাসক শের খান হুমায়ুনকে প্রথমে বাংলা ও পরে ভারত থেকে বিতাড়িত করেন। এ পর্বে বাংলার শাসন ক্ষমতা আফগানদের হাতে চলে যায় ।
ভারতে মোগলরা আবার সংগঠিত হয় এবং রাজমহলের যুদ্ধে আফগানদের পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। এরপর সম্রাট আকবরের সময় ১৫৭৬ সালে পশ্চিম বাংলা ও উত্তর বাংলার অনেকটা অংশ মোগলদের অধিকারে আসে। বাংলার পূর্বাংশ অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ অংশ সহজে মোগলরা দখল করতে পারে নি। বারোভূঁইয়া নামে পরিচিত পূর্ববাংলার জমিদাররা একযোগে মোগল আক্রমণ প্রতিহত করেন। আকবরের সেনাপতি মানসিংহ কয়েকবার চেষ্টা করেও বারোভূঁইয়াদের নেতা ঈশা খাঁকে পরাজিত করতে পারেন নি। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ১৬১০ সালে মোগল সুবেদার ইসলাম খান চিশতি চূড়ান্তভাবে বারোভূঁইয়াদের পরাজিত করে ঢাকা অধিকার করেন এবং তৎকালীন দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের নাম অনুসারে জাহাঙ্গীরনগর নামকরণ করেন। এভাবেই বাংলায় মোগল অধিকার সম্পন্ন হয়। এই মোগল শাসন চলে আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে মোগল শাসনের চূড়ান্ত অবসান ঘটে। সেই সাথে বাংলার ক্ষমতা দখল করে ইংরেজ শক্তি। আর এভাবেই শুরু হয় ঔপনিবেশিক শক্তির শাসন।
বাংলায় ইউরোপীয়দের আগমন ও বাণিজ্য বিস্তার
ইউরোপের কোনো কোনো দেশে খনিজ সম্পদের আবিষ্কার, সমুদ্রপথে বাণিজ্যের বিস্তার এবং কারিগরি ও বাণিজ্যিক বিকাশের ফলে অর্থনীতি তেজি হয়ে উঠেছিল। এর ফলে চৌদ্দ শতক থেকে ইউরোপে যুগান্তকারী বাণিজ্য-বিপ্লবের সূচনা হয়। তখন একদিকে তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হতে শুরু করে। অন্যদিকে কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রীর জন্যে বাজারের সন্ধানও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে ।
১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা সমুদ্র পথে বাণিজ্য বিস্তারের অন্বেষণে দক্ষিণ ভারতের কালিকট বন্দরে পৌঁছান । এর মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ বিশ্ব বাণিজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিণত হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ক্রমান্বয়ে এই প্রতিযোগিতায় সামিল হতে থাকে। এই লক্ষ্যে সতেরো শতকে একে একে ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (হল্যান্ড), ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইত্যাদি বাণিজ্যিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। এদের অধিকাংশের লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষ। আবার তার মধ্যে বাংলার সিল্ক ও অন্যান্য মিহি কাপড় এবং মসলা তাদের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠে।
পুঁজির শক্তিশালী প্রভাব আর উন্নত কারিগরি জ্ঞানের সমন্বয় করে ক্রমে বিদেশি বণিকরা এদেশে স্থানীয় শ্রমিকদের খাটিয়ে বড় বড় শিল্পকারখানা স্থাপন করে প্রচুর মুনাফা করতে থাকে। ক্রমে ব্যবসার ক্ষেত্রে পর্তুগিজদের চেয়ে ইংরেজদের ভূমিকা প্রাধান্য পায়। এছাড়া ফরাসি, ওলন্দাজ ও দিনেমাররাও বাংলায় কারখানা স্থাপন করে ব্যবসা শুরু করে। এই বিদেশি বণিকদের বিনিয়োগ ও ব্যবসা কেমন ছিল তার কিছুটা হদিস মিলে বিদেশি পর্যটকদেরই বর্ণনায়। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের ১৬৬৬ সালে লিখেছেন, ‘ওলন্দাজরা তাদের কাশিমবাজারের সিল্ক ফ্যাক্টরিতে কখনো কখনো ৭শ থেকে ৮শ লোক নিয়োগ করত’। ইংরেজ ও অন্যান্য জাতির বণিকরাও এরকম কারখানা চালাত। বার্নিয়ের আরও লিখেছেন, ‘শুধুমাত্র কাশিমবাজারে বছরে ২২ হাজার বেল সিল্ক উৎপাদিত হতো।’
এভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে ইউরোপের বণিকরা দেখলো বাংলায় স্থায়ী বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করেই বেশি লাভ করা সম্ভব । জব চার্ণক নামক জনৈক ইংরেজ প্রতিনিধি ১৬৯০ সালে ১২০০ টাকার বিনিময়ে কলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর নামে গ্রাম ক্রয় করেন যা পরবর্তীকালে কলকাতা নামে পরিচিত হয় । এই কলকাতাই এক সময় ইংরেজদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ বিস্তারের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। এ সময় কলকাতা, চন্দননগর, চুঁচুড়া, কাশিমবাজার প্রভৃতি স্থানে ইউরোপীয় বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে।
আর এদের মাধ্যমে বাংলা থেকে পুঁজিও পাচার হতে থাকে। বাণিজ্যিক উদ্যোগ এবং কূট কৌশলে পারদর্শী হবার কারণে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রমশঃ অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর তুলনায় প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যায় এবং তাদের উপর প্রাধান্য লাভ করে । তারা এখানে কুঠি, কারখানা তৈরি ও সৈন্য রেখে ব্যবসার অধিকার পায়। ইংরেজ কোম্পানির ক্ষমতা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায় দিল্লির সম্রাট ফাররুখশিয়ারের কাছ থেকে বাংলায় বিনা শুল্কে বাণিজ্যসহ আরো একাধিক উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক সুবিধা প্রাপ্তিতে।
এইসব সুবিধাদি তাদের দিনে দিনে উচ্চাভিলাষী এবং রাজনৈতিক ক্ষমতালোভী করে তোলে। পলাশি যুদ্ধের আগে এবং মীর জাফর ও মীর কাশিমের আমলে বাংলার প্রচুর সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার হয়ে যায়। এ সম্পদের প্রাচুর্যের কথা স্বয়ং ক্লাইভ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে সবিস্ময়ে উল্লেখ করেছিলেন।
শেষ কথা
বাংলা তথা ভারতব্যাপী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যাপক প্রসারে ভীত ইংরেজ শাসকরা শাসনতান্ত্রিক নীতি ও কর্মকান্ডে নানাভাবে ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতির প্রয়োগ ঘটাতে থাকে । ইতোপূর্বে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলার হিন্দু-মুসলমান নেতৃত্বের মধ্যে যে বিভেদের সৃষ্টি হয়েছিল তা ইংরেজদের প্ররোচনায় ক্রমশঃ প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের রূপ নিতে থাকে ।